وَ قَالُوۡا كُوۡنُوۡا هُوۡدًا اَوۡ نَصٰرٰی تَهۡتَدُوۡا ؕ قُلۡ بَلۡ مِلَّۃَ اِبۡرٰهٖمَ حَنِیۡفًا ؕ وَ مَا كَانَ مِنَ الۡمُشۡرِكِیۡنَ
আর তারা বলে, ‘তোমরা ইয়াহূদী কিংবা নাসারা হয়ে যাও, হিদায়াত পেয়ে যাবে’। বল, ‘বরং আমরা ইবরাহীমের মিল্লাতের অনুসরণ করি, যে একনিষ্ঠ ছিল এবং যে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না’।(২:১৩৫)
یٰۤاَهۡلَ الۡكِتٰبِ لِمَ تُحَآجُّوۡنَ فِیۡۤ اِبۡرٰهِیۡمَ وَ مَاۤ اُنۡزِلَتِ التَّوۡرٰىۃُ وَ الۡاِنۡجِیۡلُ اِلَّا مِنۡۢ بَعۡدِهٖ ؕ اَفَلَا تَعۡقِلُوۡنَ
হে কিতাবীগণ, তোমরা ইবরাহীমের ব্যাপারে কেন বিতর্ক কর? অথচ তাওরাত ও ইনজীল তো তার পরই অবতীর্ণ হয়েছে। সুতরাং তোমরা কি বুঝবে না? (৩:৬৫)
مَا كَانَ اِبۡرٰهِیۡمُ یَهُوۡدِیًّا وَّ لَا نَصۡرَانِیًّا وَّ لٰكِنۡ كَانَ حَنِیۡفًا مُّسۡلِمًا ؕ وَ مَا كَانَ مِنَ الۡمُشۡرِكِیۡنَ
ইবরাহীম ইয়াহূদীও ছিল না, নাসারাও ছিল না; বরং সে ছিল একনিষ্ঠ মুসলিম। আর সে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। (৩:৬৭)
اِنَّ اَوۡلَی النَّاسِ بِاِبۡرٰهِیۡمَ لَلَّذِیۡنَ اتَّبَعُوۡهُ وَ هٰذَا النَّبِیُّ وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا ؕ وَ اللّٰهُ وَلِیُّ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ
নিশ্চয় মানুষের মধ্যে ইবরাহীমের সবচেয়ে নিকটবর্তী তারা, যারা তার অনুসরণ করেছে এবং এই নবী ও মুমিনগণ। আর আল্লাহ মুমিনদের অভিভাবক।(৩:৬৮)
وَ مَنۡ اَحۡسَنُ دِیۡنًا مِّمَّنۡ اَسۡلَمَ وَجۡهَهٗ لِلّٰهِ وَ هُوَ مُحۡسِنٌ وَّ اتَّبَعَ مِلَّۃَ اِبۡرٰهِیۡمَ حَنِیۡفًا ؕ وَ اتَّخَذَ اللّٰهُ اِبۡرٰهِیۡمَ خَلِیۡلًا
আর দীনের ব্যাপারে তার তুলনায় কে উত্তম, যে সৎকর্মপরায়ণ অবস্থায় আল্লাহর কাছে নিজকে পূর্ণ সমর্পণ করল এবং একনিষ্ঠভাবে ইবরাহীমের আদর্শ অনুসরণ করল? আর আল্লাহ ইবরাহীমকে পরম বন্ধুরূপে গ্রহণ করেছেন। (৪:১২৫)
وَ مَنۡ یَّرۡغَبُ عَنۡ مِّلَّۃِ اِبۡرٰهٖمَ اِلَّا مَنۡ سَفِهَ نَفۡسَهٗ ؕ وَ لَقَدِ اصۡطَفَیۡنٰهُ فِی الدُّنۡیَا ۚ وَ اِنَّهٗ فِی الۡاٰخِرَۃِ لَمِنَ الصّٰلِحِیۡنَ
আর যে নিজকে নির্বোধ বানিয়েছে, সে ছাড়া কে ইবরাহীমের আদর্শ থেকে বিমুখ হতে পারে? আর অবশ্যই আমি তাকে দুনিয়াতে বেছে নিয়েছি এবং নিশ্চয় সে আখিরাতে নেককারদের অন্তর্ভুক্ত থাকবে।(২:১৩০)
ثُمَّ اَوۡحَیۡنَاۤ اِلَیۡكَ اَنِ اتَّبِعۡ مِلَّۃَ اِبۡرٰهِیۡمَ حَنِیۡفًا ؕ وَ مَا كَانَ مِنَ الۡمُشۡرِكِیۡنَ
তারপর আমি তোমার প্রতি ওহী পঠিয়েছি যে, তুমি মিল্লাতে ইবরাহীমের অনুসরণ কর, যে ছিল একনিষ্ঠ এবং ছিল না মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত। (১৬:১২৩)
قُلۡ صَدَقَ اللّٰهُ ۟ فَاتَّبِعُوۡا مِلَّۃَ اِبۡرٰهِیۡمَ حَنِیۡفًا ؕ وَ مَا كَانَ مِنَ الۡمُشۡرِكِیۡنَ
বল, ‘আল্লাহ সত্য বলেছেন। সুতরাং তোমরা ইবরাহীমের মিল্লাতের অনুসরণ কর একনিষ্ঠভাবে। আর সে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না’।(৩:৯৫)
اِنَّ اِبۡرٰهِیۡمَ كَانَ اُمَّۃً قَانِتًا لِّلّٰهِ حَنِیۡفًا ؕ وَ لَمۡ یَكُ مِنَ الۡمُشۡرِكِیۡنَ
নিশ্চয় ইবরাহীম ছিলেন এক উম্মত*, আল্লাহর একান্ত অনুগত ও একনিষ্ঠ। তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন না। (১৬:১২০)
وَ اِذِ ابۡتَلٰۤی اِبۡرٰهٖمَ رَبُّهٗ بِكَلِمٰتٍ فَاَتَمَّهُنَّ ؕ قَالَ اِنِّیۡ جَاعِلُكَ لِلنَّاسِ اِمَامًا ؕ قَالَ وَ مِنۡ ذُرِّیَّتِیۡ ؕ قَالَ لَا یَنَالُ عَهۡدِی الظّٰلِمِیۡنَ
আর স্মরণ কর, যখন ইবরাহীমকে তার রব কয়েকটি বাণী দিয়ে পরীক্ষা করলেন, অতঃপর সে তা পূর্ণ করল। তিনি বললেন, ‘আমি তোমাকে মানুষের জন্য নেতা বানাব’। সে বলল, ‘আমার বংশধরদের থেকেও’? তিনি বললেন, ‘যালিমরা আমার ওয়াদাপ্রাপ্ত হয় না’।(2:124)
اِنَّ اللّٰهَ اصۡطَفٰۤی اٰدَمَ وَ نُوۡحًا وَّ اٰلَ اِبۡرٰهِیۡمَ وَ اٰلَ عِمۡرٰنَ عَلَی الۡعٰلَمِیۡنَ
নিশ্চয়ই আল্লাহ আদম, নূহ ও ইবরাহীমের পরিবারকে এবং ইমরানের পরিবারকে সৃষ্টিজগতের উপর মনোনীত করেছেন।(৩:৩৩)
وَ وَهَبۡنَا لَهٗۤ اِسۡحٰقَ وَ یَعۡقُوۡبَ وَ جَعَلۡنَا فِیۡ ذُرِّیَّتِهِ النُّبُوَّۃَ وَ الۡكِتٰبَ وَ اٰتَیۡنٰهُ اَجۡرَهٗ فِی الدُّنۡیَا ۚ وَ اِنَّهٗ فِی الۡاٰخِرَۃِ لَمِنَ الصّٰلِحِیۡنَ
আর আমি তাকে দান করলাম ইসহাক ও ‘ইয়া‘কূবকে এবং তার বংশে নবুওয়াত ও কিতাব দিলাম। আর দুনিয়াতে তাকে তার প্রতিদান দিলাম এবং নিশ্চয় সে আখিরাতে সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত হবে।(২৯:২৭)
وَ لَقَدۡ اَرۡسَلۡنَا نُوۡحًا وَّ اِبۡرٰهِیۡمَ وَ جَعَلۡنَا فِیۡ ذُرِّیَّتِهِمَا النُّبُوَّۃَ وَ الۡكِتٰبَ فَمِنۡهُمۡ مُّهۡتَدٍ ۚ وَ كَثِیۡرٌ مِّنۡهُمۡ فٰسِقُوۡنَ
আর আমি তো নূহ ও ইবরাহীমকে রাসূলরূপে পাঠিয়েছিলাম এবং তাদের বংশধরদের মধ্যে নবুওয়াত ও কিতাব দিয়েছিলাম। তারপর তাদের মধ্যে কেউ কেউ সঠিক পথ অবলম্বনকারী ছিল, আর তাদের অধিকাংশই ছিল ফাসিক।(৫৭:২৬)
সামাজিক অবস্থা
وَ اِبۡرٰهِیۡمَ اِذۡ قَالَ لِقَوۡمِهِ اعۡبُدُوا اللّٰهَ وَ اتَّقُوۡهُ ؕ ذٰلِكُمۡ خَیۡرٌ لَّكُمۡ اِنۡ كُنۡتُمۡ تَعۡلَمُوۡنَ
আর (স্মরণ কর) ইবরাহীমকে, যখন সে তার কওমকে বলেছিল, ‘তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর এবং তাঁর তাকওয়া অবলম্বন কর; এটি তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যদি তোমরা জান’।(২৯:১৬)
اِنَّمَا تَعۡبُدُوۡنَ مِنۡ دُوۡنِ اللّٰهِ اَوۡثَانًا وَّ تَخۡلُقُوۡنَ اِفۡكًا ؕ اِنَّ الَّذِیۡنَ تَعۡبُدُوۡنَ مِنۡ دُوۡنِ اللّٰهِ لَا یَمۡلِكُوۡنَ لَكُمۡ رِزۡقًا فَابۡتَغُوۡا عِنۡدَ اللّٰهِ الرِّزۡقَ وَ اعۡبُدُوۡهُ وَ اشۡكُرُوۡا لَهٗ ؕ اِلَیۡهِ تُرۡجَعُوۡنَ
তোমরা তো আল্লাহকে বাদ দিয়ে মূর্তিগুলোর পূজা করছ এবং মিথ্যা বানাচ্ছ। নিশ্চয় তোমরা আল্লাহ ছাড়া যাদের উপাসনা কর তারা তোমাদের জন্য রিয্ক-এর মালিক নয়। তাই আল্লাহর কাছে রিয্ক তালাশ কর, তাঁর ইবাদাত কর এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। তাঁরই কাছে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।(২৯:১৭)
পিতার প্রতি
وَاذْكُرْ فِي الْكِتَابِ إِبْرَاهِيْمَ إِنَّهُ كَانَ صِدِّيْقاً نَّبِيًّا، إِذْ قَالَ لِأَبِيْهِ يَا أَبَتِ لِمَ تَعْبُدُ مَا لاَ يَسْمَعُ وَلاَ يُبْصِرُ وَلاَ يُغْنِي عَنكَ شَيْئاً، يَا أَبَتِ إِنِّي قَدْ جَاءنِيْ مِنَ الْعِلْمِ مَا لَمْ يَأْتِكَ فَاتَّبِعْنِيْ أَهْدِكَ صِرَاطاً سَوِيّاً، يَا أَبَتِ لاَ تَعْبُدِ الشَّيْطَانَ إِنَّ الشَّيْطَانَ كَانَ لِلرَّحْمَنِ عَصِيّاً، يَا أَبَتِ إِنِّيْ أَخَافُ أَن يَمَسَّكَ عَذَابٌ مِّنَ الرَّحْمَن فَتَكُوْنَ لِلشَّيْطَانِ وَلِيّاً
‘তুমি এই কিতাবে ইবরাহীমের কথা বর্ণনা কর। নিশ্চয়ই তিনি ছিলেন সত্যবাদী ও নবী’(১৯/৪১)। ‘যখন তিনি তার পিতাকে বললেন, হে আমার পিতা! তুমি তার পূজা কেন কর, যে শোনে না, দেখে না এবং তোমার কোন উপকারে আসে না?(৪২)। ‘হে আমার পিতা! আমার কাছে এমন জ্ঞান এসেছে, যা তোমার কাছে আসেনি। অতএব তুমি আমার অনুসরণ কর। আমি তোমাকে সরল পথ দেখাব’(৪৩)। ‘হে আমার পিতা! শয়তানের পূজা করো না। নিশ্চয়ই শয়তান দয়াময়ের অবাধ্য’(৪৪)। ‘হে আমার পিতা! আমি আশংকা করছি যে, দয়াময়ের একটি আযাব তোমাকে স্পর্শ করবে, অতঃপর তুমি শয়তানের বন্ধু হয়ে যাবে’ (মারিয়াম ১৯/৪১-৪৫)।
وَإِذْ قَالَ إِبْرَاهِيْمُ لأَبِيْهِ آزَرَ أَتَتَّخِذُ أَصْنَاماً آلِهَةً إِنِّيْ أَرَاكَ وَقَوْمَكَ فِيْ ضَلاَلٍ مُّبِيْنٍ
স্মরণ কর, যখন ইবরাহীম তার পিতা আযরকে বললেন, তুমি কি প্রতিমা সমূহকে উপাস্য মনে কর? আমি দেখতে পাচ্ছি যে, তুমি ও তোমার সম্প্রদায় স্পষ্ট বিভ্রান্তির মধ্যে রয়েছ’ (আন‘আম ৬/৭৪)।
পিতার জবাব
قَالَ أَرَاغِبٌ أَنْتَ عَنْ آلِهَتِيْ يَا إِبْرَاهِيْمُ لَئِن لَّمْ تَنْتَهِ لَأَرْجُمَنَّكَ وَاهْجُرْنِيْ مَلِيًّا-
হে ইবরাহীম! তুমি কি আমার উপাস্যদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছ? যদি তুমি বিরত না হও, তবে আমি অবশ্যই পাথর মেরে তোমার মাথা চূর্ণ করে দেব। তুমি আমার সম্মুখ হ’তে চিরতরের জন্য দূর হয়ে যাও’ (মারিয়াম ১৯/৪৬)।
ইবরাহীমের জবাব
قَالَ سَلاَمٌ عَلَيْكَ سَأَسْتَغْفِرُ لَكَ رَبِّي إِنَّهُ كَانَ بِي حَفِيّاً، وَأَعْتَزِلُكُمْ وَمَا تَدْعُونَ مِن دُونِ اللَّهِ وَأَدْعُو رَبِّي عَسَى أَلاَّ أَكُونَ بِدُعَاء رَبِّي شَقِيّاً
তোমার উপরে শান্তি বর্ষিত হৌক! আমি আমার পালনকর্তার নিকটে তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করব। নিশ্চয়ই তিনি আমার প্রতি মেহেরবান’। ‘আমি পরিত্যাগ করছি তোমাদেরকে এবং আল্লাহ ব্যতীত যাদের তোমরা পূজা কর তাদেরকে। আমি আমার পালনকর্তাকে আহবান করব। আশা করি আমার পালনকর্তাকে আহবান করে আমি বঞ্চিত হব না’ (মারিয়াম ১৯/৪৭-৪৮)।
পিতাকে ও নিজ সম্প্রদায়কে একত্রে দাওয়াত
وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ إِبْرَاهِيْمَ، إِذْ قَالَ لِأَبِيْهِ وَقَوْمِهِ مَا تَعْبُدُوْنَ، قَالُوْا نَعْبُدُ أَصْنَاماً فَنَظَلُّ لَهَا عَاكِفِيْنَ، قَالَ هَلْ يَسْمَعُونَكُمْ إِذْ تَدْعُوْنَ، أَوْ يَنْفَعُوْنَكُمْ أَوْ يَضُرُّوْنَ، قَالُوْا بَلْ وَجَدْنَا آبَاءنَا كَذَلِكَ يَفْعَلُوْنَ، قَالَ أَفَرَأَيْتُم مَّا كُنْتُمْ تَعْبُدُوْنَ، أَنتُمْ وَآبَاؤُكُمُ الْأَقْدَمُوْنَ، فَإِنَّهُمْ عَدُوٌّ لِّي إِلاَّ رَبَّ الْعَالَمِيْنَ، الَّذِيْ خَلَقَنِيْ فَهُوَ يَهْدِيْنِ، وَالَّذِيْ هُوَ يُطْعِمُنِيْ وَيَسْقِيْنِ، وَإِذَا مَرِضْتُ فَهُوَ يَشْفِيْنِ، وَالَّذِيْ يُمِيْتُنِيْ ثُمَّ يُحْيِيْنِ، وَالَّذِيْ أَطْمَعُ أَن يَّغْفِرَ لِيْ خَطِيئَتِيْ يَوْمَ الدِّيْنِ، رَبِّ هَبْ لِيْ حُكْماً وَأَلْحِقْنِيْ بِالصَّالِحِيْنَ، وَاجْعَل لِّيْ لِسَانَ صِدْقٍ فِي الْآخِرِيْنَ، َاجْعَلْنِيْ مِن وَّرَثَةِ جَنَّةِ النَّعِيْمِ، وَاغْفِرْ لِأَبِيْ إِنَّهُ كَانَ مِنَ الضَّالِّيْنَ، وَلاَ تُخْزِنِيْ يَوْمَ يُبْعَثُوْنَ، يَوْمَ لاَ يَنفَعُ مَالٌ وَّلاَ بَنُوْنَ، إِلاَّ مَنْ أَتَى اللهَ بِقَلْبٍ سَلِيْمٍ، وَأُزْلِفَتِ الْجَنَّةُ لِلْمُتَّقِيْنَ، وَبُرِّزَتِ الْجَحِيْمُ لِلْغَاوِيْنَ، وَقِيْلَ لَهُمْ أَيْنَ مَا كُنْتُمْ تَعْبُدُوْنَ، مِنْ دُوْنِ اللهِ هَلْ يَنْصُرُوْنَكُمْ أَوْ يَنْتَصِرُوْنَ، فَكُبْكِبُوْا فِيْهَا هُمْ وَالْغَاوُوْنَ، وَجُنُوْدُ إِبْلِيْسَ أَجْمَعُوْنَ، قَالُوْا وَهُمْ فِيْهَا يَخْتَصِمُوْنَ، تَاللهِ إِنْ كُنَّا لَفِيْ ضَلاَلٍ مُّبِيْنٍ، إِذْ نُسَوِّيْكُم بِرَبِّ الْعَالَمِيْنَ، وَمَا أَضَلَّنَا إِلاَّ الْمُجْرِمُوْنَ، َمَا لَنَا مِنْ شَافِعِيْنَ، وَلاَ صَدِيْقٍ حَمِيْمٍ، فَلَوْ أَنَّ لَنَا كَرَّةً فَنَكُوْنَ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ، إِنَّ فِيْ ذَلِكَ لَآيَةً وَمَا كَانَ أَكْثَرُهُم مُّؤْمِنِيْنَ
‘আর তাদেরকে ইবরাহীমের বৃত্তান্ত শুনিয়ে দিন’(শো‘আরা ২৬/৬৯)। ‘যখন সে স্বীয় পিতা ও সম্প্রদায়কে ডেকে বলল, তোমরা কিসের পূজা কর’?(৭০)। তারা বলল, আমরা প্রতিমার পূজা করি এবং সর্বদা এদেরকেই নিষ্ঠার সাথে আঁকড়ে থাকি’(৭১)। ‘সে বলল, তোমরা যখন আহবান কর, তখন তারা শোনে কি’?(৭২)। ‘অথবা তারা তোমাদের উপকার বা ক্ষতি করতে পারে কি’?(৭৩)। ‘তারা বলল, না। তবে আমরা আমাদের বাপ-দাদাদের পেয়েছি, তারা এরূপই করত’(৭৪)। ইবরাহীম বলল, তোমরা কি তাদের সম্পর্কে ভেবে দেখেছ, যাদের তোমরা পূজা করে আসছ’?(৭৫)। ‘তোমরা এবং তোমাদের পূর্ববর্তী পিতৃপুরুষেরা’(৭৬)। ‘তারা সবাই আমার শত্রু, বিশ্ব পালনকর্তা ব্যতীত’(৭৭)। ‘যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর আমাকে পথ প্রদর্শন করেছেন’ (৭৮)। ‘যিনি আমাকে আহার দেশ ও পানীয় দান করেন’ (৭৯)। ‘যখন আমি পীড়িত হই, তখন তিনিই আমাকে আরোগ্য দান করেন’(৮০)। ‘যিনি আমার মৃত্যু ঘটাবেন, অতঃপর পুনর্জীবন দান করবেন’ (৮১)। ‘আশা করি শেষ বিচারের দিন তিনি আমার ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমা করে দিবেন’ (৮২)। ‘হে আমার পালনকর্তা! আমাকে প্রজ্ঞা দান কর এবং আমাকে সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত কর’(৮৩)। ‘এবং আমাকে পরবর্তীদের মধ্যে সত্যভাষী কর’ (৮৪)। ‘তুমি আমাকে নে‘মতপূর্ণ জান্নাতের উত্তরাধিকারীদের অন্তর্ভুক্ত কর’(৮৫)। (হে প্রভু) ‘তুমি আমার পিতাকে ক্ষমা কর। তিনি তো পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভুক্ত’(৮৬) (হে আল্লাহ) ‘পুনরুত্থান দিবসে তুমি আমাকে লাঞ্ছিত কর না’ (৮৭)। ‘যে দিনে ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কোন কাজে আসবে না’ (৮৮) ‘কিন্তু যে ব্যক্তি সরল হৃদয় নিয়ে আল্লাহর কাছে আসবে’ (৮৯)। ‘(ঐ দিন) জান্নাত আল্লাহভীরুদের নিকটবর্তী করা হবে’(৯০)। ‘এবং জাহান্নাম বিপথগামীদের সামনে উন্মোচিত করা হবে’(৯১)। ‘(ঐ দিন) তাদেরকে বলা হবে, তারা কোথায় যাদেরকে তোমরা পূজা করতে’?(৯২) ‘আল্লাহর পরিবর্তে। তারা কি (আজ) তোমাদের সাহায্য করতে পারে কিংবা তারা কি কোনরূপ প্রতিশোধ নিতে পারে’? (৯৩)। ‘অতঃপর তাদেরকে এবং (তাদের মাধ্যমে) পথভ্রষ্টদেরকে অধোমুখী করে নিক্ষেপ করা হবে জাহান্নামে’(৯৪) ‘এবং ইবলীস বাহিনীর সকলকে’ (৯৫)। ‘তারা সেখানে ঝগড়ায় লিপ্ত হয়ে বলবে’(৯৬) ‘আল্লাহর কসম! আমরা প্রকাশ্য ভ্রান্তিতে ছিলাম’(৯৭), ‘যখন আমরা তোমাদেরকে (অর্থাৎ কথিত উপাস্যদেরকে) বিশ্বপালকের সমতুল্য গণ্য করতাম’(৯৮)।‘আসলে আমাদেরকে পাপাচারীরাই পথভ্রষ্ট করেছিল’ (৯৯)। ‘ফলে (আজ) আমাদের কোন সুফারিশকারী নেই’ (১০০) ‘এবং কোন সহৃদয় বন্ধুও নেই’(১০১)। ‘হায়! যদি কোনরূপে আমরা পৃথিবীতে ফিরে যাবার সুযোগ পেতাম, তাহ’লে আমরা ঈমানদারগণের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতাম’(১০২)। ‘নিশ্চয়ই এ ঘটনার মধ্যে নিদর্শন রয়েছে। বস্ত্ততঃ তাদের অধিকাংশই বিশ্বাসী ছিল না’ (১০৩)। ‘নিশ্চয়ই আপনার পালনকর্তা পরাক্রান্ত ও দয়ালু’ (শো‘আরা ২৬/৬৯-১০৪)
স্বীয় পিতা ও সম্প্রদায়ের নিকটে ইবরাহীমের দাওয়াত ও তাদের জবাবকে আল্লাহ অন্যত্র নিম্নরূপে বর্ণনা করেন। যেমন-
إِذْ قَالَ لِأَبِيْهِ وَقَوْمِهِ مَا هَذِهِ التَّمَاثِيْلُ الَّتِيْ أَنْتُمْ لَهَا عَاكِفُوْنَ، قَالُوْا وَجَدْنَا آبَاءنَا لَهَا عَابِدِيْنَ، قَالَ لَقَدْ كُنْتُمْ أَنْتُمْ وَآبَاؤُكُمْ فِيْ ضَلاَلٍ مُّبِيْنٍ، قَالُوْا أَجِئْتَنَا بِالْحَقِّ أَمْ أَنْتَ مِنَ اللاَّعِبِيْنَ، قَالَ بَل رَّبُّكُمْ رَبُّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ الَّذِيْ فَطَرَهُنَّ وَأَنَا عَلَى ذَلِكُم مِّنَ الشَّاهِدِيْنَ، وَتَاللهِ لَأَكِيْدَنَّ أَصْنَامَكُم بَعْدَ أَن تُوَلُّوْا مُدْبِرِيْنَ
ইবরাহীম স্বীয় পিতা ও সম্প্রদায়কে বলল, ‘এই মূর্তিগুলি কী যাদের তোমরা পূজারী হয়ে বসে আছ’?(আম্বিয়া ২১/৫২)। ‘তারা বলল, আমরা আমাদের বাপ-দাদাদেরকে এরূপ পূজা করতে দেখেছি’(৫৩)। ‘সে বলল, তোমরা প্রকাশ্য গুমরাহীতে লিপ্ত আছ এবং তোমাদের বাপ-দাদারাও’ (৫৪)। ‘তারা বলল, তুমি কি আমাদের কাছে সত্যসহ এসেছ, না কেবল কৌতুক করছ’? (৫৫)। ‘সে বলল, না। তিনিই তোমাদের পালনকর্তা, যিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের পালনকর্তা, যিনি এগুলো সৃষ্টি করেছেন এবং আমি এ বিষয়ে তোমাদের উপর অন্যতম সাক্ষ্যদাতা’(৫৬)। ‘আল্লাহর কসম! যখন তোমরা ফিরে যাবে, তখন আমি তোমাদের মূর্তিগুলোর ব্যাপারে একটা কিছু করে ফেলব’ (আম্বিয়া ২১/৫২-৫৭)।
ইবরাহীম মূর্তি ভাঙ্গলেন
জ্ঞানীদের ইশারাই যথেষ্ট। কিন্তু মানুষ যখন কোন কিছুর প্রতি অন্ধভক্তি পোষণ করে, তখন শত যুক্তিও কোন কাজ দেয় না। ফলে ইবরাহীম ভাবলেন, এমন কিছু একটা করা দরকার, যাতে পুরা সমাজ নড়ে ওঠে ও ওদের মধ্যে হুঁশ ফিরে আসে। সাথে সাথে তাদের মধ্যে তাওহীদী চেতনার উন্মেষ ঘটে। সেমতে তিনি সম্প্রদায়ের কেন্দ্রীয় দেবমন্দিরে গিয়ে মূর্তিগুলো ভেঙ্গে ফেলার সংকল্প করলেন।
ইবরাহীম (আঃ)-এর সম্প্রদায় বছরের একটা বিশেষ দিনে উৎসব পালন করত ও সেখানে নানারূপ অপচয় ও অশোভন কাজ করত। যেমন আজকাল প্রবৃত্তি পূজারী ও বস্ত্তবাদী লোকেরা করে থাকে কথিত সংস্কৃতির নামে। এইসব মেলায় সঙ্গত কারণেই কোন নবীর যোগদান করা সম্ভব নয়। কওমের লোকেরা তাকে উক্ত মেলায় যোগদানের আমন্ত্রণ জানালো।
فَقَالَ اِنِّیۡ سَقِیۡمٌ
তারপর বলল, ‘আমি তো অসুস্থ’ (৩৭:৮৯)
فَتَوَلَّوۡا عَنۡهُ مُدۡبِرِیۡنَ
অতঃপর ওরা তাকে পশ্চাতে রেখে চলে গেল।(৩৭:৯০)
অতঃপর তিনি দেবালয়ে ঢুকে পড়লেন ও দেব-দেবীদের দিকে লক্ষ্য করে বললেন, (তোমাদের সামনে এত নযর-নেয়ায ও ভোগ-নৈবেদ্য রয়েছে)
فَرَاغَ اِلٰۤی اٰلِهَتِهِمۡ فَقَالَ اَلَا تَاۡكُلُوۡنَ
তারপর চুপে চুপে সে তাদের দেবতাদের কাছে গেল এবং বলল, ‘তোমরা কি খাবে না?’ (৩৭:৯১)
مَا لَكُمۡ لَا تَنۡطِقُوۡنَ
‘তোমাদের কী হয়েছে যে, তোমরা কথা বলছ না’? (৩৭:৯২)
فَرَاغَ عَلَیۡهِمۡ ضَرۡبًۢا بِالۡیَمِیۡنِ
অতঃপর সে তাদের উপর সজোরে আঘাত হানল। (৩৭:৯৩)
فَجَعَلَهُمۡ جُذٰذًا اِلَّا كَبِیۡرًا لَّهُمۡ لَعَلَّهُمۡ اِلَیۡهِ یَرۡجِعُوۡنَ
অতঃপর সে মূর্তিগুলোকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিল তাদের বড়টি ছাড়া, যাতে তারা তাঁর দিকে ফিরে আসে। (২১:৫৮)
মেলা শেষে লোকজন ফিরে এল এবং যথারীতি দেবমন্দিরে গিয়ে প্রতিমাগুলির অবস্থা দেখে হতবাক হয়ে গেল। ‘তারা বলাবলি করতে লাগল, এটা নিশ্চয়ই ইবরাহীমের কাজ হবে। কেননা তাকেই আমরা সবসময় মূর্তি পূজার বিরুদ্ধে বলতে শুনি। অতঃপর ইবরাহীমকে সেখানে ডেকে আনা হ’ল এবং জিজ্ঞেস করল, أَأَنتَ فَعَلْتَ هَذَا بِآلِهَتِنَا يَا إِبْرَاهِيمُ؟ ‘হে ইবরাহীম! তুমিই কি আমাদের উপাস্যদের সাথে এরূপ আচরণ করেছ’? (আম্বিয়া ২১/৬২)।
ইবরাহীম বললেন, بَلْ فَعَلَهُ كَبِيرُهُمْ هَذَا فَاسْأَلُوهُمْ إِنْ كَانُوا يَنْطِقُوْنَ- ‘বরং এই বড় মূর্তিটাই একাজ করেছে। নইলে এদেরকে জিজ্ঞেস কর, যদি তারা কথা বলতে পারে’ (আম্বিয়া ২১/৬৩)। সম্প্রদায়ের নেতারা একথা শুনে লজ্জা পেল এবং মাথা নীচু করে বলল, قَدْ عَلِمْتَ مَا هَؤُلاَء يَنْطِقُوْنَ- ‘তুমি তো জানো যে, এরা কথা বলে না’। ‘তিনি বললেন, قَالَ أَفَتَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللهِ مَا لاَ يَنفَعُكُمْ شَيْئاً وَّلاَ يَضُرُّكُمْ- ‘তোমরা কি আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুর ইবাদত কর, যা তোমাদের উপকারও করতে পারে না, ক্ষতিও করতে পারে না’ (আম্বিয়া ২১/৬৫-৬৬)। তিনি আরও বললেন,قَالَ أَتَعْبُدُونَ مَا تَنْحِتُونَ، وَالله خَلَقَكُمْ وَمَا تَعْمَلُونَ- ‘তোমরা এমন বস্ত্তর পূজা কর, যা তোমরা নিজ হাতে তৈরী কর’? ‘অথচ আল্লাহ তোমাদেরকে ও তোমাদের কর্মসমূহকে সৃষ্টি করেছেন’ (ছাফফাত ৩৭/৯৫-৯৬)।أُفٍّ لَّكُمْ وَلِمَا تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللهِ أَفَلاَ تَعْقِلُونَ- ‘ধিক তোমাদের জন্য এবং আল্লাহ ব্যতীত তোমরা যাদের পূজা কর, ওদের জন্য। তোমরা কি বুঝ না’? (আম্বিয়া ২১/৬৭)।
তারপর যা হবার তাই হ’ল। যিদ ও অহংকারের বশবর্তী হয়ে সম্প্রদায়ের নেতারা ইবরাহীমকে চূড়ান্ত শাস্তি দেওয়ার পরিকল্পনা করল। তারা সিদ্ধান্ত নিল যে, একে আর বাঁচতে দেওয়া যাবে না। শুধু তাই নয়, একে এমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে মারতে হবে, যেন কেউ এর দলে যেতে সাহস না করে। তারা তাঁকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার প্রস্তাব গ্রহণ করল এবং সেটা বাদশাহ নমরূদের কাছে পেশ করল। সম্রাটের মন্ত্রী ও দেশের প্রধান পুরোহিতের ছেলে ইবরাহীম। অতএব তাকে সরাসরি সম্রাটের দরবারে আনা হ’ল।
নমরূদের সঙ্গে বিতর্ক ও অগ্নিপরীক্ষা
ইবরাহীম (আঃ) এটাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে তাওহীদের দাওয়াত দেওয়ার সুযোগ হিসাবে গ্রহণ করলেন। নমরূদ ৪০০ বছর ধরে রাজত্ব করায় সে উদ্ধত ও অহংকারী হয়ে উঠেছিল এবং নিজেকে একমাত্র উপাস্য ভেবেছিল। তাই সে ইবরাহীমকে জিজ্ঞেস করল, বল তোমার উপাস্য কে? নমরূদ ভেবেছিল, ইবরাহীম তাকেই উপাস্য বলে স্বীকার করবে। কিন্তু নির্ভীক কণ্ঠে ইবরাহীম জবাব দিলেন, رَبِّيَ الَّذِيْ يُحْيِـيْ وَيُمِيْتُ ‘আমার পালনকর্তা তিনি, যিনি মানুষকে বাঁচান ও মারেন’। মোটাবুদ্ধির নমরূদ বলল, أَنَا أُحْيِـيْ وَأُمِيْتُ ‘আমিও বাঁচাই ও মারি’। অর্থাৎ মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামীকে খালাস দিয়ে মানুষকে বাঁচাতে পারি। আবার খালাসের আসামীকে মৃত্যুদন্ড দিতে পারি। এভাবে সে নিজেকেই মানুষের বাঁচা-মরার মালিক হিসাবে সাব্যস্ত করল। ইবরাহীম তখন দ্বিতীয় যুক্তি পেশ করে বললেন, فَإِنَّ اللهَ يَأْتِيْ بِالشَّمْسِ مِنَ الْمَشْرِقِ فَأْتِ بِهَا مِنَ الْمَغْرِبِ ‘আমার আল্লাহ সূর্যকে পূর্ব দিক থেকে উদিত করেন, আপনি তাকে পশ্চিম দিক হ’তে উদিত করুন’। فَبُهِتَ الَّذِيْ كَفَرَ ‘অতঃপর কাফের (নমরূদ) এতে হতবুদ্ধি হয়ে পড়লো’ (বাক্বারাহ ২/২৫৮)।
কওমের নেতারাই যেখানে পরাজয়কে মেনে নেয়নি, সেখানে দেশের একচ্ছত্র সম্রাট কেন পরাজয়কে মেনে নিবেন। যথারীতি তিনিও অহংকারে ফেটে পড়লেন এবং ইবরাহীমকে জ্বলন্ত হুতাশনে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার নির্দেশ জারি করলেন। সাথে সাথে জনগণকে ধর্মের দোহাই দিয়ে বললেন, حَرِّقُوهُ وَانصُرُوا آلِهَتَكُمْ إِنْ كُنتُمْ فَاعِلِيْنَ ‘তোমরা একে পুড়িয়ে মার এবং তোমাদের উপাস্যদের সাহায্য কর, যদি তোমরা কিছু করতে চাও’ (আম্বিয়া ২১/৬৮)। উল্লেখ্য যে, কুরআন কোথাও নমরূদের নাম উল্লেখ করেনি এবং সে যে নিজেকে ‘সর্বোচ্চ উপাস্য’ দাবী করেছিল, এমন কথাও স্পষ্টভাবে বলেনি। তবে ‘আমিও বাঁচাতে পারি ও মারতে পারি’ (বাক্বারাহ ২/২৫৮) তার এই কথার মধ্যে তার সর্বোচ্চ অহংকারী হবার এবং ইবরাহীমের ‘রব’-এর বিপরীতে নিজেকে এভাবে উপস্থাপন করায় সে নিজেকে ‘সর্বোচ্চ রব’ হিসাবে ধারণা করেছিল বলে প্রতীয়মান হয়। প্রধানত: ইস্রাঈলী বর্ণনাসমূহের উপরে ভিত্তি করেই ‘নমরূদ’-এর নাম ও তার রাজত্ব সম্পর্কে জানা যায়। কুরআন কেবল অতটুকুই বলেছে, যতটুকু মানব জাতির হেদায়াতের জন্য প্রয়োজন।
যুক্তিতর্কে হেরে গিয়ে নমরূদ ইবরাহীম (আঃ)-কে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার হুকুম দিল। অতঃপর তার জন্য বিরাটাকারের আয়োজন শুরু হয়ে গেল। আল্লাহ বলেন, وَأَرَادُوْا بِهِ كَيْداً فَجَعَلْنَاهُمُ الْأَخْسَرِيْنَ، ‘তারা ইবরাহীমের বিরুদ্ধে মহা ফন্দি অাঁটতে চাইল। অতঃপর আমরা তাদেরকেই সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত করে দিলাম’ (আম্বিয়া ২১/৭০)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, فَجَعَلْنَاهُمُ الْأَسْفَلِينَ، ‘আমরা তাদেরকে পরাভূত করে দিলাম’ (ছাফফাত ৩৭/৯৮)।
অতঃপর ‘একটা ভিত নির্মাণ করা হ’ল এবং সেখানে বিরাট অগ্নিকুন্ড তৈরী করা হ’ল। তারপর সেখানে তাকে নিক্ষেপ করা হ’ল’ (ছাফফাত ৩৭/৯৭)। ছহীহ বুখারীতে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হয়েছে যে, জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপের সময় ইবরাহীম (আঃ) বলে ওঠেন, حَسْبُنَا اللهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ، ‘আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি কতই না সুন্দর তত্ত্বাবধায়ক’।[9]
বস্ত্ততঃ এই কঠিন মুহূর্তের পরীক্ষায় জয়লাভ করার পুরস্কার স্বরূপ সাথে সাথে আল্লাহর নির্দেশ এল قُلْنَا يَا نَارُ كُونِيْ بَرْداً وَّسَلاَماً عَلَى إِبْرَاهِيمَ، ‘হে আগুন! ঠান্ডা হয়ে যাও এবং ইবরাহীমের উপরে শান্তিদায়ক হয়ে যাও’ (আম্বিয়া ২১/৬৯)। অতঃপর ইবরাহীম মুক্তি পেলেন।
অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ইবরাহীম (আঃ) ফিরে আসেন এবং এভাবে আল্লাহ কাফিরদের সমস্ত কৌশল বরবাদ করে দেন। এরপর শুরু হ’ল জীবনের আরেক অধ্যায়।
ইবরাহীমের হিজরত-পূর্ব বিদায়ী ভাষণ
আল্লাহর ভাষায়, قَدْ كَانَتْ لَكُمْ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ فِي إِبْرَاهِيمَ وَالَّذِينَ مَعَهُ إِذْ قَالُوْا لِقَوْمِهِمْ إِنَّا بُرَآؤُا مِنكُمْ وَمِمَّا تَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللهِ كَفَرْنَا بِكُمْ وَبَدَا بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةُ وَالْبَغْضَاءُ أَبَداً حَتَّى تُؤْمِنُوْا بِاللهِ وَحْدَهُ إِلاَّ قَوْلَ إِبْرَاهِيْمَ لِأَبِيْهِ لَأَسْتَغْفِرَنَّ لَكَ وَمَا أَمْلِكُ لَكَ مِنَ اللهِ مِنْ شَيْءٍ، رَبَّنَا عَلَيْكَ تَوَكَّلْنَا وَإِلَيْكَ أَنَبْنَا وَإِلَيْكَ الْمَصِيرُ-
‘তোমাদের জন্য ইবরাহীম ও তার সাথীদের মধ্যে উত্তম আদর্শ নিহিত রয়েছে। যখন তারা তাদের সম্প্রদায়কে বলেছিল, আমরা সম্পর্ক ছিন্ন করছি তোমাদের সাথে এবং তাদের সাথে যাদেরকে তোমরা পূজা কর আল্লাহ্কে বাদ দিয়ে। আমরা তোমাদেরকে প্রত্যাখ্যান করছি এবং আমাদের ও তোমাদের মাঝে স্থায়ী শত্রুতা ও বিদ্বেষ বিঘোষিত হ’ল যতদিন না তোমরা কেবলমাত্র এক আল্লাহর উপরে বিশ্বাস স্থাপন করবে। ... প্রভু হে! আমরা কেবল তোমার উপরেই ভরসা করছি এবং তোমার দিকেই মুখ ফিরাচ্ছি ও তোমার নিকটেই আমাদের প্রত্যাবর্তন স্থল’ (মুমতাহানাহ ৬০/৪)। এরপর তিনি কওমকে উদ্দেশ্য করে বললেন, إِنِّي ذَاهِبٌ إِلَى رَبِّي سَيَهْدِيْنِ، ‘আমি চললাম আমার প্রভুর পানে, সত্বর তিনি আমাকে পথ দেখাবেন’ (ছাফফাত ৩৭/৯৯)। অতঃপর তিনি চললেন দিশাহীন যাত্রাপথে।
আল্লাহ বলেন, وَنَجَّيْنَاهُ وَلُوطاً إِلَى الْأَرْضِ الَّتِي بَارَكْنَا فِيهَا لِلْعَالَمِيْنَ، ‘আর আমরা তাকে ও লূতকে উদ্ধার করে নিয়ে গেলাম সেই দেশে, যেখানে বিশ্বের জন্য কল্যাণ রেখেছি’ (আম্বিয়া ২১/৭১)। এখানে তাঁর সাথী বিবি সারা-র কথা বলা হয়নি নারীর গোপনীয়তা রক্ষার শিষ্টাচারের প্রতি খেয়াল করে। আধুনিক নারীবাদীদের জন্য এর মধ্যে শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে।
অতঃপর আল্লাহ তাঁকে এবং তাঁর স্ত্রী সারা ও ভাতিজা লূতকে পথ প্রদর্শন করে নিয়ে গেলেন পার্শ্ববর্তী দেশ শাম বা সিরিয়ার অন্তর্গত বায়তুল মুক্বাদ্দাসের অদূরে কেন‘আন নামক স্থানে, যা এখন তাঁর নামানুসারে ‘খালীল’ (الخليل ) নামে পরিচিত হয়েছে। ঐ সময় সেখানে বায়তুল মুক্বাদ্দাসের অস্তিত্ব ছিল না। এখানেই ইবরাহীম (আঃ) বাকী জীবন অতিবাহিত করেন ও এখানেই কবরস্থ হন। এখানে হিজরতের সময় তাঁর বয়স ৮০ থেকে ৮৫-এর মধ্যে ছিল এবং বিবি সারা-র ৭০ থেকে ৭৫-এর মধ্যে। সঙ্গী ভাতিজা লূতকে আল্লাহ নবুঅত দান করেন ও তাকে পার্শ্ববর্তী সমৃদ্ধ নগরী সাদূমসহ পাঁচটি নগরীর লোকদের হেদায়াতের উদ্দেশ্যে পাঠানো হয় ও তিনি সেখানেই বসবাস করেন। ফলে ইবরাহীমের জীবনে নিঃসঙ্গতার এক কষ্টকর অধ্যায় শুরু হয়।
উল্লেখ্য যে, মানবজাতির প্রথম ফসল ডুমুর (তীন) বর্তমান ফিলিস্তীনেই উৎপন্ন হয়েছিল আজ থেকে এগারো হাযার বছর আগে। সম্প্রতি সেখানে প্রাপ্ত শুকনো ডুমুর পরীক্ষা করে এ তথ্য জানা গেছে।[12]
কেন‘আনের জীবন
জন্মভূমি বাবেল শহরে জীবনের প্রথমাংশ অতিবাহিত করার পর হিজরত ভূমি শামের কেন‘আনে তিনি জীবনের বাকী অংশ কাটাতে শুরু করেন। তাঁর জীবনের অন্যান্য পরীক্ষা সমূহ এখানেই অনুষ্ঠিত হয়। কিছু দিন অতিবাহিত করার পর এখানে শুরু হয় দুর্ভিক্ষ। মানুষ সব দলে দলে ছুটতে থাকে মিসরের দিকে। মিসর তখন ফেরাঊনদের শাসনাধীনে ছিল। উল্লেখ্য যে, মিসরের শাসকদের উপাধি ছিল ‘ফেরাঊন’। ইবরাহীম ও মূসার সময় মিসর ফেরাঊনদের শাসনাধীনে ছিল।
দুর্ভিক্ষ তাড়িত কেন‘আন হ’তে অন্যান্যদের ন্যায় ইবরাহীম (আঃ) সস্ত্রীক মিসরে রওয়ানা হ’লেন। ইচ্ছা করলে আল্লাহ তাঁর জন্য এখানেই রূযী পাঠাতে পারতেন। কিন্তু না। তিনি মিসরে কষ্টকর সফরে রওয়ানা হ’লেন। সেখানে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল এক কঠিন ও মর্মান্তিক পরীক্ষা এবং সাথে সাথে একটি নগদ ও অমূল্য পুরষ্কার।
ঐ সময় মিসরের ফেরাঊন ছিল একজন নারী লোলুপ মদ্যপ শাসক। তার নিয়োজিত লোকেরা রাস্তার পথিকদের মধ্যে কোন সুন্দরী মহিলা পেলেই তাকে ধরে নিয়ে বাদশাহকে পৌঁছে দিত। যদিও বিবি ‘সারা’ ঐ সময় ছিলেন বৃদ্ধা মহিলা, তথাপি তিনি ছিলেন সৌন্দর্য্যের রাণী। মিসরীয় সম্রাটের নিয়ম ছিল এই যে, যে মহিলাকে তারা অপহরণ করত, তার সাথী পুরুষ লোকটি যদি স্বামী হ’ত, তাহ’লে তাকে হত্যা করে মহিলাকে নিয়ে যেত। আর যদি ভাই বা পিতা হ’ত, তাহ’লে তাকে ছেড়ে দিত। তারা ইবরাহীমকে জিজ্ঞেস করলে তিনি সারাকে তাঁর ‘বোন’ পরিচয় দিলেন। নিঃসন্দেহে ‘সারা’ তার ইসলামী বোন ছিলেন। ইবরাহীম তাকে আল্লাহর যিম্মায় ছেড়ে দিয়ে ছালাতে দাঁড়িয়ে গেলেন ও আল্লাহর নিকটে স্বীয় স্ত্রীর ইয্যতের হেফাযতের জন্য আকুলভাবে প্রার্থনা করতে থাকলেন। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, আল্লাহ নিশ্চয়ই তার স্ত্রীর ইয্যতের হেফাযত করবেন।
সারাকে যথারীতি ফেরাঊনের কাছে আনা হ’ল। অতঃপর পরবর্তী ঘটনা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
حَدَّثَنَا أَبُو الْيَمَانِ، أَخْبَرَنَا شُعَيْبٌ، حَدَّثَنَا أَبُو الزِّنَادِ، عَنِ الأَعْرَجِ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ ـ رضى الله عنه ـ قَالَ قَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم " هَاجَرَ إِبْرَاهِيمُ ـ عَلَيْهِ السَّلاَمُ ـ بِسَارَةَ، فَدَخَلَ بِهَا قَرْيَةً فِيهَا مَلِكٌ مِنَ الْمُلُوكِ، أَوْ جَبَّارٌ مِنَ الْجَبَابِرَةِ، فَقِيلَ دَخَلَ إِبْرَاهِيمُ بِامْرَأَةٍ، هِيَ مِنْ أَحْسَنِ النِّسَاءِ. فَأَرْسَلَ إِلَيْهِ أَنْ يَا إِبْرَاهِيمُ، مَنْ هَذِهِ الَّتِي مَعَكَ قَالَ أُخْتِي. ثُمَّ رَجَعَ إِلَيْهَا، فَقَالَ لاَ تُكَذِّبِي حَدِيثِي فَإِنِّي أَخْبَرْتُهُمْ أَنَّكِ أُخْتِي، وَاللَّهِ إِنْ عَلَى الأَرْضِ مُؤْمِنٌ غَيْرِي وَغَيْرُكِ. فَأَرْسَلَ بِهَا إِلَيْهِ، فَقَامَ إِلَيْهَا، فَقَامَتْ تَوَضَّأُ وَتُصَلِّي فَقَالَتِ اللَّهُمَّ إِنْ كُنْتُ آمَنْتُ بِكَ وَبِرَسُولِكَ وَأَحْصَنْتُ فَرْجِي، إِلاَّ عَلَى زَوْجِي فَلاَ تُسَلِّطْ عَلَىَّ الْكَافِرَ. فَغُطَّ حَتَّى رَكَضَ بِرِجْلِهِ ". قَالَ الأَعْرَجُ قَالَ أَبُو سَلَمَةَ بْنُ عَبْدُ الرَّحْمَنِ إِنَّ أَبَا هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَتِ اللَّهُمَّ إِنْ يَمُتْ يُقَالُ هِيَ قَتَلَتْهُ. فَأُرْسِلَ ثُمَّ قَامَ إِلَيْهَا، فَقَامَتْ تَوَضَّأُ تُصَلِّي، وَتَقُولُ اللَّهُمَّ إِنْ كُنْتُ آمَنْتُ بِكَ وَبِرَسُولِكَ، وَأَحْصَنْتُ فَرْجِي، إِلاَّ عَلَى زَوْجِي، فَلاَ تُسَلِّطْ عَلَىَّ هَذَا الْكَافِرَ، فَغُطَّ حَتَّى رَكَضَ بِرِجْلِهِ. قَالَ عَبْدُ الرَّحْمَنِ قَالَ أَبُو سَلَمَةَ قَالَ أَبُو هُرَيْرَةَ فَقَالَتِ اللَّهُمَّ إِنْ يَمُتْ فَيُقَالُ هِيَ قَتَلَتْهُ، فَأُرْسِلَ فِي الثَّانِيَةِ، أَوْ فِي الثَّالِثَةِ، فَقَالَ وَاللَّهِ مَا أَرْسَلْتُمْ إِلَىَّ إِلاَّ شَيْطَانًا، ارْجِعُوهَا إِلَى إِبْرَاهِيمَ، وَأَعْطُوهَا آجَرَ. فَرَجَعَتْ إِلَى إِبْرَاهِيمَ ـ عَلَيْهِ السَّلاَمُ ـ فَقَالَتْ أَشَعَرْتَ أَنَّ اللَّهَ كَبَتَ الْكَافِرَ وَأَخْدَمَ وَلِيدَةً.
আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ইবরাহীম (আঃ) সারাকে সঙ্গে নিয়ে হিজরত করলেন এবং এমন এক জনপদে প্রবেশ করলেন, যেখানে এক বাদশাহ ছিল, অথবা বললেন, এক অত্যাচারী শাসক ছিল। তাকে বলা হলো যে, ইবরাহীম (নামক এক ব্যক্তি) এক পরমা সুন্দরী নারীকে নিয়ে (আমাদের এখানে) প্রবেশ করেছে। সে তখন তার নিকট লোক পাঠিয়ে জিজ্ঞেস করল, হে ইবরাহীম, তোমার সঙ্গে এ নারী কে? তিনি বললেন, আমার বোন। অতঃপর তিনি সারার নিকট ফিরে এসে বললেন, তুমি আমার কথা মিথ্যা মনে করো না। আমি তাদেরকে বলেছি যে, তুমি আমার বোন। আল্লাহ্র শপথ! দুনিয়াতে (এখন) তুমি আর আমি ব্যতীত আর কেউ মু’মিন নেই। সুতরাং আমি আর তুমি দ্বীনী ভাই বোন। এরপর ইবরাহীম (আঃ) (বাদশাহর নির্দেশে) সারাকে বাদশাহর নিকট পাঠিয়ে দিলেন। বাদশাহ তাঁর দিকে অগ্রসর হল। সারা উযূ করে করে সালাত আদায়ে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং এ দু’আ করলেন, হে আল্লাহ্ ! আমিও তোমার উপর এবং তোমার রসূলের উপর ঈমান এনেছি এবং আমার স্বামী ব্যতীত সকল হতে আমার লজ্জাস্থানকে সংরক্ষণ করেছি। তুমি এই কাফিরকে আমার উপর ক্ষমতা দিও না। তখন বাদশাহ বেহুঁশ হয়ে পড়ে মাটিতে পায়ের আঘাত করতে লাগলো। তখন সারা বললেন, আয় আল্লাহ্! এ যদি মারা যায় তবে লোকে বলবে, স্ত্রীলোকটি একে হত্যা করেছে। তখন সে সংজ্ঞা ফিরে পেল। এভাবে দু’বার বা তিনবারের পর বাদশাহ বলল, আল্লাহ্র শপথ! তোমরা তো আমার নিকট এক শয়তানকে পাঠিয়েছ। একে ইবরাহীমের নিকট ফিরিয়ে দাও এবং তার জন্য হাজেরাকে হাদিয়া স্বরূপ দান কর। সারাহ ইবরাহীম (আঃ)-এর নিকট ফিরে এসে বললেন, আপনি জানেন কি, আল্লাহ্ তা’আলা কাফিরকে লজ্জিত ও নিরাশ করেছেন এবং সে এক বাঁদী হাদিয়া হিসেবে দিয়েছেন। (সহিহ বুখারী, হাদিস নং ২২১৭)
কেন‘আনে প্রত্যাবর্তন
ইবরাহীম (আঃ) যথারীতি মিসর থেকে কেন‘আনে ফিরে এলেন। বন্ধ্যা স্ত্রী সারা তার খাদেমা হাজেরাকে প্রাণপ্রিয় স্বামী ইবরাহীমকে উৎসর্গ করলেন। ইবরাহীম তাকে স্ত্রীত্বে বরণ করে নিলেন। পরে দ্বিতীয়া স্ত্রী হাজেরার গর্ভে জন্ম গ্রহণ করেন তার প্রথম সন্তান ইসমাঈল (আঃ)। এই সময় ইবরাহীমের বয়স ছিল অন্যূন ৮৬ বছর। নিঃসন্তান পরিবারে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। শুষ্ক মরুতে যেন প্রাণের জোয়ার এলো। বস্ত্তত: ইসমাঈল ছিলেন নিঃসন্তান ইবরাহীমের দো‘আর ফসল। কেননা তিনি বৃদ্ধ বয়সে আল্লাহর নিকটে ‘নেককার সন্তান’ কামনা করেছিলেন। যেমন আল্লাহ বলেন, رَبِّ هَبْ لِي مِنَ الصَّالِحِيْنَ، فَبَشَّرْنَاهُ بِغُلاَمٍ حَلِيْمٍ- ‘(ইবরাহীম বললেন,) হে আমার প্রতিপালক! আমাকে একটি সৎকর্মশীল সন্তান দাও। অতঃপর আমরা তাকে একটি ধৈর্য্যশীল পুত্রের সুসংবাদ দিলাম।’ (ছাফফাত ৩৭/১০০-১০১)।
মিসর থেকে ফিরে কেন‘আনে আসার বৎসরাধিককাল পরে প্রথম সন্তান ইসমাঈলের জন্ম লাভ হয়। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই তিনি শিশু সন্তান ও তার মা হাজেরাকে মক্কার বিজন পাহাড়ী উপত্যকায় নিঃসঙ্গভাবে রেখে আসার এলাহী নির্দেশ লাভ করেন। বস্ত্ততঃ এটা ছিল অত্যন্ত মর্মান্তিক পরীক্ষা। এ বিষয়ে বর্ণনা নিম্নরূপ:
وَفِي رواية : فَجَاءَ فَقَالَ : أَيْنَ إِسْمَاعِيلُ ؟ فَقَالَتْ امْرأتُهُ : ذَهَبَ يَصِيدُ ؛ فَقَالَتِ امْرَأتُهُ : أَلاَ تَنْزِلُ فَتَطْعَمَ وَتَشْرَبَ ؟ قَالَ : وَمَا طَعَامُكُمْ وَمَا شَرَابُكُمْ ؟ قَالَتْ : طَعَامُنَا اللَّحْمُ وَشَرَابُنَا المَاءُ، قَالَ : اللَّهُمَّ بَارِكْ لَهُمْ فِي طَعَامِهِمْ وَشَرابِهِمْ قَالَ : فَقَالَ أَبُو القَاسِمِ ﷺ بَرَكَةُ دَعوَةِ إبْرَاهِيمَ قَالَ : فَإِذَا جَاءَ زَوْجُكِ فَاقْرَئِي عَلَيْهِ السَّلاَمَ وَمُرِيِهِ يُثَبِّتُ عَتَبَةَ بَابِهِ فَلَمَّا جَاءَ إِسْمَاعِيلُ قَالَ: هَلْ أَتَاكُمْ مِنْ أَحَدٍ ؟ قَالَتْ : نَعَمْ أَتَانَا شَيْخٌ حَسَنُ الهَيْئَةِ وَأثْنَتْ عَلَيْهِ فَسَألَنِي عَنْكَ فَأَخْبَرتُهُ فَسَألَنِي كَيْفَ عَيْشُنَا فَأَخْبَرْتُهُ أَنَّا بِخَيْرٍ قَالَ : فَأَوْصَاكِ بِشَيءٍ ؟ قَالَتْ : نَعَمْ يَقْرَأُ عَلَيْكَ السَّلاَمَ وَيَأمُرُكَ أَنْ تُثَبِّتَ عَتَبَةَ بَابِكَ قَالَ : ذَاكَ أَبِـيْ وَأَنْتِ العَتَبَةُ أَمَرَنِي أَنْ أُمْسِكَكِ ثُمَّ لَبِثَ عَنْهُمَ مَا شَاءَ اللهُ ثُمَّ جَاءَ بَعدَ ذٰلِكَ وَإِسْمَاعِيلُ يَبْرِي نَبْلاً لَهُ تَحْتَ دَوْحَةٍ قَريباً مِنْ زَمْزَمَ فَلَمَّا رَآهُ قَامَ إِلَيْهِ فَصَنَعَا كَمَا يَصْنَعُ الوَالِدُ بِالوَلَدِ وَالوَلَدُ بِالوَالدِ قَالَ : يَا إِسْمَاعِيلُ إِنَّ اللهَ أَمَرَنِي بِأَمْرٍ قَالَ : فَاصْنَعْ مَا أمَرَكَ رَبُّكَ ؟ قالَ : وَتُعِينُنِي قَالَ : وَأُعِينُكَ قَالَ : فَإِنَّ اللهَ أَمَرَنِي أَنْ أَبْنِي بَيْتاً هَاهُنَا وَأَشَارَ إِلٰـى أَكَمَةٍ مُرْتَفِعَةٍ عَلٰى مَا حَوْلَهَا، فَعِنْدَ ذٰلِكَ رَفَعَ القَوَاعِدَ مِنَ البَيْتِ، فَجَعَلَ إِسْمَاعِيلُ يَأتِي بِالحِجَارَةِ وَإِبْرَاهِيمُ يَبْنِي حَتّٰـى إِذَا ارْتَفَعَ البِنَاءُ، جَاءَ بِهذَا الحَجَرِ فَوَضَعَهُ لَهُ فَقَامَ عَلَيْهِ، وَهُوَ يَبْنِي وَإِسْمَاعِيلُ يُنَاوِلُهُ الحِجَارَةَ وَهُمَا يَقُولاَنِ: رَبَّنَا تَقَبَّلْ مِنَّا إِنَّكَ أنْتَ السَّمِيعُ العَلِيمُ: وفي روايةٍ : إِنَّ إِبْرَاهِيمَ خَرَجَ بِإِسْمَاعِيلَ وَأُمِّ إِسْمَاعِيلَ، مَعَهُمْ شَنَّةٌ فِيهَا مَاءٌ فَجَعَلَتْ أُمُّ إِسْمَاعِيلَ تَشْرَبُ مِنَ الشَّنَّةِ فَيَدِرُّ لَبَنُهَا عَلٰى صَبِيِّهَا حَتّٰـى قَدِمَ مَكَّةَ فَوَضَعَهَا تَحْتَ دَوْحَةٍ ثُمَّ رَجَعَ إِبْرَاهِيمُ إِلٰـى أَهْلِهِ فَاتَّبَعَتْهُ أُمُّ إِسْمَاعِيلَ حَتّٰـى لَمَّا بَلَغُوا كَدَاءَ نَادَتْهُ مِنْ وَرَائِهِ : يَا إِبْرَاهِيمُ إِلٰـى مَنْ تَتْرُكُنَا ؟ قَالَ : إِلٰـى اللهِ قَالَتْ : رَضِيْتُ بِاللهِ فَرَجَعَتْ وَجَعَلَتْ تَشْرَبُ مِنَ الشِّنَّةِ وَيَدُرُّ لَبَنُهَا عَلٰى صَبِيِّهَا حَتّٰـى لَمَّا فَنِيَ المَاءُ قَالَتْ : لَوْ ذَهَبْتُ فَنَظَرْتُ لَعَلِّي أُحِسُّ أَحَداً قَالَ : فَذَهَبَتْ فَصَعِدَتِ الصَّفَا فَنَظَرَتْ وَنَظَرَتْ هَلْ تُحِسُّ أَحَداً فَلَمْ تُحِسَّ أَحَداً فَلَمَّا بَلَغَتِ الوَادِيَ سَعَتْ، وَأَتَتِ المَرْوَةَ وَفَعَلَتْ ذٰلِكَ أَشْوَاطَاً ثُمَّ قَالَتْ : لَوْ ذَهَبْتُ فَنَظَرْتُ مَا فَعَلَ الصَّبِيُّ، فَذَهَبَتْ فَنَظَرَتْ فَإِذَا هُوَ عَلٰى حَالِهِ كَأنَّهُ يَنْشَغُ لِلْمَوْتِ فَلَمْ تُقِرَّهَا نَفْسُهَا فَقَالَتْ : لَوْ ذَهَبْتُ فَنَظَرْتُ لَعَلِّي أُحِسُّ أَحَداً فَذَهَبَتْ فَصَعِدَتِ الصَّفَا فَنَظَرَتْ وَنَظَرَتْ فَلَمْ تُحِسَّ أَحَداً حَتّٰـى أَتَمَّتْ سَبْعاً، ثُمَّ قَالَتْ : لَوْ ذَهَبْتُ فَنَظَرْتُ مَا فَعَلَ فَإِذَا هِيَ بِصَوْتٍ فَقَالَتْ : أَغِثْ إِنْ كَانَ عِنْدَكَ خَيْرٌ فَإِذَا جِبْرِيلُ ﷺ فَقَالَ بِعقِبِهِ هَكَذَا وَغَمَزَ بِعَقِبِهِ عَلَى الأَرْضِ فَانْبَثَقَ المَاءُ فَدَهِشَتْ أُمُّ إِسْمَاعِيلَ، فَجَعَلَتْ تَحْفِنُ وَذَكَرَ الحَديثَ بِطُولِهِ رواه البخاري بهذه الروايات كلها
ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, ইব্রাহীম (আঃ) ইসমাঈলের মা (হাজার; যা বাংলায় প্রসিদ্ধ হাজেরা) ও তাঁর দুধের শিশু ইসমাঈলকে সঙ্গে নিয়ে কা’বা ঘরের নিকট এবং যমযমের উপরে একটি বড় গাছের তলে (বর্তমান) মসজিদের সবচেয়ে উঁচু জায়গায় তাঁদেরকে রাখলেন। তখন মক্কায় না ছিল জনমানব, না ছিল কোন পানি। সুতরাং সেখানেই তাদেরকে রেখে গেলেন এবং একটি থলের মধ্যে কিছু খেজুর আর একটি মশকে স্বল্প পরিমাণ পানি দিয়ে গেলেন। তারপর ইব্রাহীম (আঃ) ফিরে যেতে লাগলেন। তখন ইসমাঈলের মা তাঁর পিছু পিছু ছুটে এসে বললেন, ’হে ইব্রাহীম! আমাদেরকে এমন এক উপত্যকায় ছেড়ে দিয়ে আপনি কোথায় যাচ্ছেন, যেখানে না আছে কোন সঙ্গী-সাথী আর না আছে অন্য কিছু?’ তিনি বারংবার এ কথা বলতে থাকলেন। কিন্তু ইব্রাহীম (আঃ) সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করলেন না। তখন হাজেরা তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, ’আল্লাহ কি আপনাকে এর হুকুম দিয়েছেন?’ তিনি উত্তরে বললেন, ’হ্যাঁ।’ উত্তর শুনে হাজেরা বললেন, ’তাহলে তিনি আমাদেরকে ধ্বংস ও বরবাদ করবেন না।’ অতঃপর হাজেরা ফিরে এলেন।
ইব্রাহীম (আঃ) চলে গেলেন। পরিশেষে যখন তিনি (হাজূনের কাছে) সানিয়্যাহ নামক স্থানে এসে পৌঁছলেন, যেখানে স্ত্রী-পুত্র আর তাঁকে দেখতে পাচ্ছিলেন না, তখন তিনি কা’বা ঘরের দিকে মুখ ক’রে দু’হাত তুলে এই দু’আ করলেন, ’’হে আমাদের প্রতিপালক! আমি আমার কিছু বংশধরকে ফল-ফসলহীন উপত্যকায় তোমার পবিত্র গৃহের নিকট বসবাস করালাম; হে আমাদের প্রতিপালক! যাতে তারা নামায কায়েম করে। সুতরাং তুমি কিছু লোকের অন্তরকে ওদের প্রতি অনুরাগী ক’রে দাও এবং ফলাদি দ্বারা তাদের জীবিকার ব্যবস্থা কর; যাতে তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।’’ (সূরা ইব্রাহীম ৩৭)
(অতঃপর ইব্রাহীম (আঃ) চলে গেলেন।) ইসমাঈলের মা শিশুকে দুধ পান করাতেন আর নিজে ঐ মশক থেকে পানি পান করতেন। পরিশেষে ঐ মশকের পানি শেষ হয়ে গেলে তিনি নিজেও পিপাসিত হলেন এবং (ঐ কারণে বুকের দুধ শুকিয়ে যাওয়ায়) তাঁর শিশুপুত্রটিও পিপাসায় কাতর হয়ে পড়ল। তিনি শিশুর প্রতি তাকিয়ে দেখলেন, (পিপাসায়) শিশু মাটির উপর ছট্ফট্ করছে। শিশু পুত্রের (এ করুণ অবস্থার) দিকে তাকানো তার পক্ষে সহ্য হচ্ছিল না। তিনি সরে পড়লেন এবং তাঁর অবস্থান ক্ষেত্রের নিকটতম পর্বত হিসাবে ’স্বাফা’কে পেলেন। তিনি তার উপর উঠে দাঁড়িয়ে উপত্যকার দিকে মুখ ক’রে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলেন, কাউকে দেখা যায় কি না। কিন্তু তিনি কাউকে দেখতে পেলেন না। তখন স্বাফা পর্বত থেকে নেমে আসলেন। অতঃপর যখন তিনি উপত্যকায় পৌঁছলেন, তখন আপন পিরানের (ম্যাঙির) নিচের দিক তুলে একজন শ্রান্তকস্নান্ত মানুষের মত দৌড়ে উপত্যকা পার হলেন। অতঃপর ’মারওয়া’ পাহাড়ে এসে তার উপরে উঠে দাঁড়ালেন। অতঃপর চারিদিকে দৃষ্টিপাত ক’রে কাউকে দেখার চেষ্টা করলেন। কিন্তু কাউকে দেখতে পেলেন না। (এইভাবে তিনি পাহাড়দ্বয়ের মাঝখানে) সাতবার (আসা-যাওয়া) করলেন। ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ’’এ কারণে (হজ্জের সময়) হাজীগণের এই পাহাড়দ্বয়ের মধ্যে সাতবার সায়ী বা দৌড়াদৌড়ি করতে হয়।’’
এভাবে শেষবার যখন তিনি মারওয়া পাহাড়ের উপর উঠলেন, তখন একটি আওয়াজ শুনতে পেলেন। তখন তিনি নিজেকেই বললেন, ’চুপ!’ অতঃপর তিনি কান খাড়া ক’রে ঐ আওয়াজ শুনতে লাগলেন। আবারও সেই আওয়ায শুনতে পেলেন। তখন তিনি বললেন, ’তোমার আওয়াজ তো শুনতে পেলাম। এখন যদি তোমার কাছে সাহায্যের কিছু থাকে, তবে আমাকে সাহায্য কর।’ হঠাৎ তিনি যমযম যেখানে অবস্থিত সেখানে ( জিবরীল) ফিরিশতাকে দেখতে পেলেন। ফিরিশতা তাঁর পায়ের গোড়ালি দিয়ে অথবা নিজ ডানা দিয়ে আঘাত করলেন। ফলে (আঘাতের স্থান থেকে) পানি প্রকাশ পেল। হাজেরা এর চার পাশে নিজ হাত দ্বারা বাঁধ দিয়ে তাকে হওযের রূপদান করলেন এবং অঞ্জলি ভরে তার মশকটিতে পানি ভরতে লাগলেন। হাজেরার ভরা শেষ হলেও পানি উথলে উঠতে থাকল।
ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ’’আল্লাহ ইসমাঈলের মায়ের উপর করুণা বর্ষণ করুন। যদি তিনি যমযমকে (বাঁধ না দিয়ে ঐভাবে) ছেড়ে দিতেন। অথবা যদি তিনি অঞ্জলি দিয়ে মশক না ভরতেন, তবে যমযম (কূপ না হয়ে) একটি প্রবহমান ঝর্ণা হত।’’
বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর হাজেরা নিজে পানি পান করলেন এবং শিশু পুত্রকেও দুধ পান করালেন। তখন ফিরিশতা তাঁকে বললেন, ’ধ্বংসের কোন আশংকা করবেন না। কেননা, এখানেই মহান আল্লাহর ঘর রয়েছে। এই শিশু তার পিতার সাথে মিলে এটি পুনর্নির্মাণ করবেন। আর আল্লাহ তাঁর খাস লোককে ধ্বংস করেন না।’ ঐ সময় বায়তুল্লাহ (আল্লাহর ঘরের পরিত্যক্ত স্থানটি) যমীন থেকে টিলার মত উঁচু হয়ে ছিল। স্রোতের পানি এলে তার ডান-বাম দিয়ে বয়ে যেত।
হাজেরা এইভাবে দিন যাপন করছিলেন। শেষ পর্যন্ত জুরহুম গোত্রের কিছু লোক ’কাদা’ নামক স্থানের পথ বেয়ে পার হয়ে যাচ্ছিল। তারা মক্কার নীচু ভূমিতে অবতরণ করল এবং দেখতে পেল কতকগুলো পাখী চক্রাকারে উড়ছে। তখন তারা বলল, ’নিশ্চয় এই পাখিগুলি পানির উপরই ঘুরছে। অথচ আমরা এ ময়দানে বহুকাল কাটিয়েছি। কিন্তু কখনো এখানে কোন পানি দেখিনি।’ অতঃপর তারা একজন বা দু’জন দূত সেখানে পাঠাল। তারা গিয়েই পানি দেখতে পেল। ফিরে এসে সবাইকে পানির খবর দিল। খবর পেয়ে সবাই সেদিকে এসে দেখল, ইসমাঈলের মা পানির নিকট বসে আছেন। তারা তাঁকে বলল, ’আমরা আপনার নিকটবর্তী স্থানে বসবাস করতে চাই। আপনি আমাদেরকে অনুমতি দেবেন কি?’ তিনি উত্তরে বললেন, ’হ্যাঁ। তবে এ পানির উপর তোমাদের কোন স্বত্বাধিকার থাকবে না।’ তারা বলল, ’ঠিক আছে।’
ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ’’এ ঘটনা ইসমাঈলের মায়ের জন্য এক সুবর্ণ সুযোগ এনে দিল। যেহেতু তিনি তো সঙ্গী-সাথীই চাচ্ছিলেন। সুতরাং তারা তাদের পরিবার-পরিজনের কাছেও খবর পাঠাল। তারাও এসে তাদের সাথে বসবাস করতে লাগল। শেষ পর্যন্ত সেখানে তাদের অনেক ঘর-বাড়ি হল। ইসমাঈলও বড় হলেন। তাদের নিকট থেকে (তাদের ভাষা) আরবী শিখলেন। বড় হলে তারা তাঁকে পছন্দ করল এবং তাঁর প্রতি মুগ্ধ হল। অতঃপর তিনি যৌবনপ্রাপ্ত হলে তারা তাদেরই এক মেয়ের সঙ্গে তাঁর বিবাহ দিলেন। এরপর ইসমাঈলের মা মৃত্যুবরণ করলেন।
ইসমাঈলের বিবাহের পর ইব্রাহীম (আঃ) তাঁর পরিত্যক্ত পরিজনকে দেখার জন্য এখানে এলেন। কিন্তু এসে ইসমাঈলকে পেলেন না। পরে তাঁর স্ত্রীর নিকট তাঁর সম্পর্কে জানতে চাইলেন। স্ত্রী বললেন, ’তিনি আমাদের রুযীর সন্ধানে বেরিয়ে গেছেন।’ এক বর্ণনা অনুযায়ী -’আমাদের জন্য শিকার করতে গেছেন।’ আবার তিনি পুত্রবধূর কাছে তাঁদের জীবনযাত্রা ও অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলেন। বধূ বললেন, ’আমরা অতিশয় দুর্দশা, দুরবস্থা, টানাটানি এবং ভীষণ কষ্টের মধ্যে আছি।’ তিনি ইব্রাহীম (আঃ)-এর নিকট নানা অভিযোগ করলেন। তিনি তাঁর পুত্রবধূকে বললেন, ’তোমার স্বামী বাড়ি এলে তাঁকে আমার সালাম জানাবে এবং বলবে, সে যেন তার ঘরের দরজার চৌকাঠ বদলে নেয়।’ এই বলে তিনি চলে গেলেন।
ইসমাঈল যখন বাড়ি ফিরে এলেন, তখন তিনি ইব্রাহীমের আগমন সম্পর্কে একটা কিছু ইঙ্গিত পেয়ে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, ’তোমাদের নিকট কেউ কি এসেছিলেন?’ স্ত্রী বললেন, ’হ্যাঁ, এই এই আকৃতির একজন বয়স্ক লোক এসেছিলেন। আপনার সম্পর্কে আমাকে জিজ্ঞেস করছিলেন। আমি তাঁকে আপনার খবর দিলাম। পুনরায় আমাকে আমাদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে আমি তাuঁক জানালাম যে, আমরা খুবই দুঃখকষ্ট ও অভাবে আছি।’ ইসমাঈল বললেন, ’তিনি তোমাকে কোন কিছু অসিয়ত ক’রে গেছেন কি?’ স্ত্রী জানালেন, ’হ্যাঁ, তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়ে গেছেন, আপনাকে তার সালাম পৌঁছাতে এবং আরো বলেছেন, আপনি যেন আপনার দরজার চৌকাঠ বদলে ফেলেন।’ ইসমাঈল (আঃ) বললেন, ’তিনি ছিলেন আমার পিতা এবং তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়ে গেছেন, যেন তোমাকে আমি তালাক দিয়ে দিই। কাজেই তুমি তোমার বাপের বাড়ি চলে যাও।’
সুতরাং ইসমাঈল (আঃ) তাঁকে তালাক দিয়ে দিলেন এবং ’জুরহুম’ গোত্রের অন্য একটি মেয়েকে বিবাহ করলেন। অতঃপর যতদিন আল্লাহ চাইলেন ইব্রাহীম (আঃ) ততদিন এঁদের থেকে দূরে থাকলেন। পরে আবার দেখতে এলেন। কিন্তু ইসমাঈল (আঃ) সেদিনও বাড়িতে ছিলেন না। তিনি পুত্রবধূর ঘরে প্রবেশ করলেন এবং ইসমাঈল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। স্ত্রী জানালেন তিনি আমাদের খাবারের সন্ধানে বেরিয়ে গেছেন। ইব্রাহীম (আঃ) জিজ্ঞাসা করলেন, ’তোমরা কেমন আছ?’ তিনি তাঁর নিকট তাঁদের জীবনযাত্রা ও সাংসারিক অবস্থা সম্পর্কেও জানতে চাইলেন? পুত্রবধূ উত্তরে বললেন, ’আমরা ভাল অবস্থায় এবং সচ্ছলতার মধ্যে আছি।’ এ বলে তিনি আল্লাহর প্রশংসাও করলেন। ইব্রাহীম (আঃ) তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, ’তোমাদের প্রধান খাদ্য কী?’ পুত্রবধূ উত্তরে বললেন, ’মাংস।’ বললেন, ’তোমাদের পানীয় কী?’ বধূ বললেন, ’পানি।’ ইব্রাহীম (আঃ) দু’আ করলেন, ’হে আল্লাহ! এদের মাংস ও পানিতে বরকত দাও।’ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ’’ঐ সময় তাদের এলাকায় খাদ্যশস্য উৎপন্ন হত না। যদি হত, তাহলে ইব্রাহীম (আঃ) সে ব্যাপারে তাঁদের জন্য দু’আ ক’রে যেতেন।’’
বর্ণনাকারী বলেন, মক্কার বাইরে কোন লোকই শুধু মাংস এবং পানি দ্বারা জীবন-যাপন করতে পারে না। কেননা, শুধু মাংস ও পানি (সর্বদা) তার স্বাস্থ্যের অনুকূল হতে পারে না।
আলাপ শেষে ইব্রাহীম (আঃ) পুত্রবধূকে বললেন, ’তোমার স্বামীকে আমার সালাম বলবে এবং তাকে আমার পক্ষ থেকে হুকুম করবে, সে যেন তার দরজার চৌকাঠ বহাল রাখে।’
অন্য এক বর্ণনায় আছে, ইব্রাহীম (আঃ) এসে বললেন, ’ইসমাঈল কোথায়?’ পুত্রবধূ বললেন, ’তিনি শিকার করতে গেছেন।’ অতঃপর তিনি বললেন, ’আপনি কি নামবেন না, কিছু পানাহার করবেন না।’ তিনি বললেন, ’তোমাদের খাদ্য ও পানীয় কী?’ বধূ বললেন, ’আমাদের খাদ্য মাংস এবং পানীয় পানি।’ তিনি দু’আ দিয়ে বললেন, ’’হে আল্লাহ! এদের গোসত ও পানিতে বরকত দাও।’’ আবুল কাসেম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ’’ইব্রাহীমের দু’আর বরকত, (মক্কায় প্রকাশ পেয়েছে)।’’
ইব্রাহীম (আঃ) বললেন, ’তোমার স্বামী এলে তাকে সালাম বলে দিয়ো এবং আদেশ করো, সে যেন তার দরজার চৌকাঠ অপরিবর্তিত রাখে।’
অতঃপর ইসমাঈল (আঃ) যখন বাড়ি এসে স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন, ’তোমাদের নিকট কেউ এসেছিলেন কি?’ স্ত্রী বললেন, ’হ্যাঁ, একজন সুন্দর আকৃতির বৃদ্ধ এসেছিলেন। (অতঃপর স্ত্রী তাঁর প্রশংসা করলেন ও বললেন,) তারপর তিনি আপনার সম্পর্কে জানতে চাইলেন, আমি তখন তাঁকে আপনার খবর বললাম। অতঃপর তিনি আমাদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে জানতে চাইলেন। আমি তাঁকে খবর দিলাম যে, আমরা ভালই আছি।’ স্বামী বললেন, ’আর তিনি তোমাকে কোন অসিয়ত করেছেন কি?’ স্ত্রী বললেন, ’তিনি আপনাকে সালাম বলেছেন এবং আপনার দরজার চৌকাঠ অপরিবর্তিত রাখার নির্দেশ দিয়ে গেছেন।’ ইসমাঈল (আঃ) তাঁর স্ত্রীকে বললেন, ’তিনি আমার আববা, আর তুমি হলে চৌকাঠ। তিনি নির্দেশ দিয়ে গেছেন, আমি যেন তোমাকে স্ত্রী হিসাবে বহাল রাখি।’
অতঃপর ইব্রাহীম (আঃ) আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী কিছুদিন তাঁদের থেকে দূরে থাকলেন। পরে আবারো তাঁদের নিকট এলেন। ইসমাঈল (আঃ) তখন যমযমের নিকটস্থ একটি বড় গাছের নীচে বসে নিজের তীর ছুলছিলেন। পিতাকে আসতে দেখে দাঁড়িয়ে তাঁর দিকে এগিয়ে গেলেন। অতঃপর উভয়ে পিতা-পুত্রের সাক্ষাৎকালীন যথাযথ আচরণ প্রদর্শন করলেন। তারপর ইব্রাহীম (আঃ) বললেন, ’হে ইসমাঈল! আল্লাহ আমাকে একটি কাজের হুকুম দিয়েছেন।’ ইসমাঈল (আঃ) বললেন, ’আপনার প্রতিপালক যা আদেশ দিয়েছেন, তা সম্পাদন ক’রে ফেলুন।’ ইব্রাহীম (আঃ) বললেন, ’তুমি আমার সহযোগিতা করবে কি?’ ইসমাঈল (আঃ) বললেন, ’(হ্যাঁ, অবশ্যই) আমি আপনার সহযোগিতা করব।’ ইব্রাহীম (আঃ) পার্শ্ববর্তী যমীনের তুলনায় উঁচু একটি টিলার দিকে ইঙ্গিত ক’রে বললেন, ’এখানে একটি ঘর বানাতে আল্লাহ আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন।’
অতঃপর ইব্রাহীম (আঃ) কা’বা ঘরের ভিত উঠাতে লেগে গেলেন। পুত্র ইসমাঈল (আঃ) তাঁকে পাথর যোগান দিতে থাকলেন। আর তিনি দেওয়াল গাঁথতে লাগলেন। অতঃপর যখন দেওয়াল উঁচু হল, তখন ইসমাঈল এই পাথর (মাক্বামে ইব্রাহীম) নিয়ে এসে তাঁর সামনে রাখলেন। তিনি তার উপর খাড়া হয়ে পাথর গাঁথতে লাগলেন। আর ইসমাঈল (আঃ) তাঁকে পাথর তুলে দিতে থাকলেন। সেই সময় উভয়েই এই দু’আ করতে থাকলেন ’হে আমাদের মহান প্রতিপালক! আমাদের নিকট থেকে এ কাজটুকু গ্রহণ কর। নিশ্চয়ই তুমি সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞাতা।’ (সূরা বাক্বারাহ ১২৭)
অন্য এক বর্ণনায় আছে, ইব্রাহীম ইসমাঈল ও তাঁর মাকে সঙ্গে নিয়ে বের হলেন। তাঁদের সঙ্গে ছিল একটি মশক; তাতে পানি ছিল। ঈসমাঈলের মা সেই পানি পান করতেন ও তাতেই তাঁর শিশুর জন্য দুধ জমে উঠত। পরিশেষে মক্কায় পৌঁছে ইব্রাহীম তাঁদেরকে বড় গাছের নিচে রেখে নিজ (অন্যান্য) পরিজনের নিকট ফিরে যেতে লাগলেন। ইসমাঈলের মা তাঁর পিছন ধরলেন। অতঃপর যখন তাঁরা কাদা’ নামক স্থানে উপস্থিত হলেন, তখন তিনি তাঁর পিছন থেকে ডাক দিলেন, ’হে ইব্রাহীম! আপনি আমাদেরকে কার ভরসায় ছেড়ে যাচ্ছেন?’ তিনি বললেন, ’আল্লাহর ভরসায়।’ (হাজেরা) বললেন, ’আল্লাহকে নিয়ে আমি সন্তুষ্ট।’ তারপর তিনি ফিরে এলেন। তিনি সেই পানি পান করতে লাগলেন ও তাতেই তাঁর শিশুর জন্য দুধ জমে উঠতে লাগল। অবশেষে যখন পানি শেষ হয়ে গেল, তখন তিনি (মনে মনে) বললেন, ’অন্যত্র গিয়ে দেখি, যদি কারো সন্ধান পাই।’
বর্ণনাকারী বলেন, ’’সুতরাং তিনি গিয়ে স্বাফা পর্বতে চড়লেন। অতঃপর তিনি চারিদিকে নজর ফিরিয়ে দেখতে লাগলেন, কেউ কোথাও আছে কি না? কিন্তু কেউ কোথাও আছে বলে তিনি অনুভব করলেন না। অতএব (স্বাফা থেকে নেমে অন্যত্র হাঁটতে লাগলেন এবং) যখন উপত্যকায় এসে পৌঁছলেন, তখন ছুটতে লাগলেন। অতঃপর মারওয়াতে এসে পৌঁছলেন। এইভাবে তিনি কয়েক চক্র করলেন। তারপর (মনে মনে) বললেন, ’গিয়ে দেখি আবার ছেলে কী করছে?’ সুতরাং তিনি গিয়ে দেখলেন, সে পূর্বের অবস্থায় আছে। সে যেন মৃত্যুযন্ত্রণায় ছট্ফট্ করছে। তা দেখে তিনি অস্থির হয়ে উঠলেন। তিনি (মনে মনে) বললেন, ’গিয়ে দেখি, যদি কারো সন্ধান পাই।’ সুতরাং তিনি গিয়ে স্বাফা পর্বতে চড়লেন। অতঃপর তিনি চারিদিকে নজর ফিরিয়ে দেখতে লাগলেন, কেউ কোথাও আছে কি না? কিন্তু কেউ কোথাও আছে বলে তিনি অনুভব করলেন না। এইভাবে তিনি সাতবার (আসা-যাওয়া) পূর্ণ করলেন। তারপর (মনে মনে) বললেন, ’গিয়ে দেখি আবার ছেলে কী করছে?’ এমন সময় এক (গায়বী) আওয়াজ শুনলেন। তিনি বললেন, ’আপনার নিকট যদি কোন মঙ্গল থাকে, তাহলে আমাদেরকে সাহায্য করুন।’ দেখলেন, তিনি জিবরীল (আঃ)। তিনি তাঁর পায়ের গোড়ালি দ্বারা এইভাবে আঘাত করলেন। আর অমনি পানির ঝর্ণাধারা বের হয়ে এল। তা দেখে ইসমাঈলের মা বিস্ময়াবিষ্টা হলেন এবং অঞ্জলি ভরে মশকে ভরতে লাগলেন----।’’ অতঃপর বর্ণনাকারী বাকী দীর্ঘ হাদীস বর্ণনা করলেন। (এ সকল বর্ণনাগুলি বুখারীর ৩৩৬৪-৩৩৬৫)
........
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন